মৌমিতার কিন্নর কণ্ঠে রাহাতের ঘুম ভাঙল। তারপরও সে চোখ
বন্ধ করে আছে। চোখ বন্ধ করে সে বুঝার চেষ্টা করছে যে
মৌমিতা এখন কী কী করছে। তোয়ালে দিয়ে চুল আঁচড়ানোর
শব্দ পাওয়া যাচ্ছে তারমানে মৌমিতা গোসল করে এসেছে।
এখন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মৌমিতা তোয়ালে দিয়ে চুল
জড়িয়ে বিছানার কাছে আসতেই রাহাত তাকে জোরে টান
দিয়ে বিছানায় নিয়ে জড়িয়ে ধরল।
-এই, হচ্ছেটা কী? ছাড়। অসভ্যতা কর না, প্লিজ। যে কেউ চলে
আসবে।
-আসুক। আমি তোমাকে ধরেই থাকব।
-আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি। ছাড়।
-না, আমি আম্মুকে চা আনতে বলছি।
রাহাত জোরে ডেকে বলল, আম্মু, আমার চা দিয়ে যাও।
-আমি থাকতে আম্মু কেন চা দিবে?
-তুমি তো জান, দিনের প্রথম চা আমি আম্মুর হাতে বানানো চা
খাই, আর চা খেতে খেতে তোমাকে দেখি। এটা তো আমাদের
রুটিন, নাকি?
-হয়েছে আমার রুটিনওয়ালা। এখন উঠে বস।
রাহাত উঠে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাহাতের আম্মু রোজী চা
নিয়ে ঢুকলেন। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা
হাসি দিলেন।
-নে, তোর চা।
চায়ে চুমুক না দিয়ে রাহাত বলল,আম্মু, চায়ে চিনি দাওনি?
-দিয়েছি তো। তুই তো মুখেই দিস নাই, চিনি দিয়েছি কি না
বুঝবি কেমনে?
-তুমি আমার রুমে ঢুকেই এমন মিষ্টি একটা হাসি দিলে, আমি
ভাবলাম চায়ে চিনি দাওনি। হাসি দিয়ে চা মিষ্টি করছ।
ছেলের এই রসিকতায় রোজী খুব মজা পেলেন। ছেলের মাথায়
হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
-আচ্ছা, আম্মু সকালবেলা আমার রুমে এলে তুমি কথা না বলে
মিটিমিটি করে হাস কেন?
-কারণ, সকালবেলা আমার জানপাখি অনেক মজার মজার কথা
বলে, তাই শোনার জন্য।
রাহাত চায়েরকাপ মৌমিতার দিকে এগিয়ে দিল। দুইজনে
এককাপে চা খাচ্ছে। এর সাথে পৃথিবীর অন্য কোন রোমান্সের
তুলনা হয় না। একফোঁটা চা মৌমিতার অধর বেয়ে গড়িয়ে
যাচ্ছে। রাহাত মৌমিতার চায়ে সিক্ত অধর নিজের মুখের মধ্যে
নিয়ে নিল।
মৌমিতা নিজেকে রাহাতের থেকে ছাড়িয়ে বলল, সকালবেলা
তোমার কাছে আসাটাই ভুল। তাড়াতাড়ি ওঠ। বাথরুমে যাও,
ব্রাশ কর, গোসল কর। সময় মাত্র বিশ মিনিট। এরমধ্যে আমি
রেডি হব।
-কেন? কোথাও যাবে নাকি?
-ফাজলামি না? তুমিই তো রাতে বললে আজ...
-হয়েছে, আর ঠোঁট ফোলাতে হবে না। আমার মনে আছে। কোন
শাড়িটা পরবে?
-অতি জঘন্য নীল শাড়ি যা আমার জানের কাছে অতিপ্রিয়।
রাহাত গোসল করে রেডি হয়ে গেছে। মৌমিতার এখনো হয়নি।
মেয়েদের এই একটা সমস্যা। সাজতে সাজতে দিন শেষ। রাহাত
অপেক্ষা করতে লাগল। মৌমিতার আগমনে রাহাতের
অপেক্ষার অবসান হল। রাহাত চোখ ফেরাতে পারছে না। পরী
বা অপ্সরী বললে ভুল হবে। যেন মৌমিতার কপালের এক কোনা
থেকে সামান্য রূপ নিয়ে সকল পরীকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে।
-অনেক দেরী হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি চল।
-তোমার দেরী হওয়া অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম। আই লাভ ইউ,
মৌ। আই লাভ ইউ, বৌ।
রাহাত মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। মৌমিতা পিছনে বসা। শহরের
মধ্যে ধীরেধীরে চালাতে হচ্ছে। মৌমিতা বলল, আজ টঙের
দোকানে চা-নাস্তা করব। ভাল একটা দোকান দেখে গাড়ি
থামাও।
বাধ্য স্বামী স্ত্রীর কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। একটা
টঙের দোকানের সামনে তারা থামল। সকাল সাড়ে আটটার মত
বাজে। শীত বেশি নয়, তবুও রাহাত পকেটে হাত ঢুকিয়ে
রেখেছে। মৌমিতা রাহাতের হাত জড়িয়ে ধরল। রাস্তার পাশে
একটা বড় বটগাছের নিচে বেদিতে বসল। এর আগে রাহাত
দুইকাপ চায়ের অর্ডার দিয়েছে।
তখন দোকানদার কেমনভাবে যেন তাকিয়েছিল। রাহাত মনে
মনে বলল, আরে ভাই। চা চেয়েছি, অন্যকিছু চাইনি। এভাবে
তাকিয়ে দেখার কী আছে?
চা নিয়ে রাহাত বেদী দেওয়া বটগাছের নিচে এল। মৌমিতা
চায়ের কাপটা দুহাতে ধরেছে।
-তোমার শীত লাগছে?
-হালকা লাগছে। তোমার লাগছে না?
-আমারও হালকা লাগছে।
রাহাত মৌমিতার হাত ধরল। রাস্তার লোকজন তাদের দিকে
কেমন ভাবে তাকাচ্ছে। এই একটা সমস্যা। রাস্তায় সুন্দরী বউ
নিয়ে বের হওয়া মুশকিল। সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে। আরে
ভাই, সৌন্দর্য উপভোগ করতে হবে ঠিক আছে, তাই বলে হা করে
তাকিয়ে থাকতে হবে?
চা শেষ করে রাহাত বিল দিতে গেল। দোকানদার আগের মতই
তাকে দেখছে।
-ভাইজানের কোন সমস্যা হয়েছে?
-কী সমস্যা হবে? আপনি চায়ের দাম রাখুন।
মৌমিতা চেঁচিয়ে বলল, একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে আস।
রাহাত সিগারেট এনে বলল, আমি খুবই সৌভাগ্যবান। একমাত্র
আমার বউই সিগারেট পছন্দ করে।
-না স্যার। আমি যখন আপনার প্রেমে পড়েছিলাম, তখনকার কথা
মনে আছে?
-না, মনে করিয়ে দাও।
-আপনি তখন সিগারেট এমনভাবে ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখতেন,
আপনার সেই স্টাইলটা আমার খুব ভাল লাগত। এখন আপনি
সেভাবে সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখবেন। তবে খবরদার,
সিগারেট টান দিয়ে ধোয়া ভিতরে নিবেন না। বুঝলেন?
-আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু দয়া করে আপনি আপনি বলা বন্ধ কর।
-ওকে। এখন যাওয়া যাক।
রাহাত মোটরসাইকেল স্টার্ট দিল। মৌমিতা একটা হাত
রাহাতের কাঁধে রেখেছে। মোটরসাইকেলের গতি খুবই কম।
-আচ্ছা, তুমি কি জোরে চালাতে পার না? নাকি তোমার গাড়ি
জোরে চলে না?
-আরে না, জোরে চালালে তোমার ভয় করবে, ঠাণ্ডা লাগবে।
তাই আস্তে চালাচ্ছি।
-তুমি জোরে চালালে আমি তোমাকে অনেক জোরে জড়িয়ে
ধরব। ভয়ও করবে না, শীতও করবে না।
সাথে সাথে রাহাত মোটরসাইকেলের এক্সিলারেটর বাড়িয়ে
দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গতির মিটারের কাটা একশকে অতিক্রম
করল। মৌমিতা অনেক জোরে রাহাতকে জড়িয়ে ধরেছে।
বাতাসে রাহাতের চুল উড়ছে। মৌমিতা নাক দিয়ে রাহাতের
ঘাড়ে সুরসুরি দিচ্ছে। হাইওয়ে প্রায় ফাঁকা। কিছুক্ষণের মধ্যে
তারা আশুলিয়া এসে পড়ল। রাস্তার দুপাশে সাদা কাশফুল
দেখা যাচ্ছে। বিশাল ফাঁকা জায়গা। রাস্তার পাশে
মোটরসাইকেল রেখে তারা দুজনে ঘাসের উপর বসল। রাহাত পা
ভাঁজ করে বসেছে। আর মৌমিতা পা লম্বা করে দিয়েছে। মৃদু
বাতাসে মৌমিতার রেশমি চুল উড়ে রাহাতের মুখে এসে পড়ছে।
রাহাত চুল সরাচ্ছে না। উদাসভাবে মৌমিতার হাসি হাসি
মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে মৌমিতার
গালে একটা চুমু দিল। মৌমিতা কেঁপে উঠল। কিছু বলল না।
কেউ কোন কথা বলছে না। তবুও কেউ বিরক্ত হচ্ছে না। মৌমিতা
বলল, তোমার প্রিয় গানটা গাও না।
-কোনটা?
-যে গানটা তুমি সবচেয়ে সুন্দর গাও।
রাহাত শুরু করল,
"বলেছিলে তাই, চিঠি লিখে যাই,
কথা আর সুরে সুরে,
মন বলে তুমি, রয়েছ যে কাছে,
আঁখি বলে কত দূরে।
তুমি আজ কত দূরে, তুমি আজ কত দুরে।
আঁখির আড়ালে চলে গেছ তবু,
রয়েছ হৃদয় জুড়ে, তুমি আজ কত দূরে।
গান শেষ হলে মৌমিতা রাহাতের একটা হাত জড়িয়ে ধরে
কাঁধে মাথা রাখল।
-আচ্ছা মৌ, আমি যদি হঠাৎ করে মারা যায়, তুমি কি একা
থাকতে পারবে?
কী যেন বলতে গিয়ে মৌমিতা কেঁদে উঠল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে
বলল, এমন কথা বলতে তোমাকে নিষেধ করেছি না? তুমি জান
না, এরকম কথা শুনলে আমি কতটা কষ্ট পাই?
-সরি, মৌ। সরি বৌ।
-ঠিক আছে, আর সরি বলতে হবে না। আর কখনো এমন কথা বললে
তোমার জিভ কেটে দিব। তখন কথাই বলতে পারবে না।
-তাহলে ভাল হবে। আমার কথা তুমি বলবে।
-তোমার কথা আমি বুঝব কিভাবে?
-কেন? আমি চোখের দিকে তাকিয়ে।
-আমি কি সত্যিই তোমার চোখের ভাষা বুঝতে পারি?
-অবশ্যই পার। তুমি না পারলে, কে পারবে বল?
-হয়েছে। আর ন্যাকামি করতে হবে না।
-আমি ন্যাকামি করছি?
-হুম, তা ছাড়া আর কী? বলেই মৌমিতা ঠোঁট টিপে হাসতে
লাগল। যখন যে ঠোঁট টিপে হাসে, তখন ঠোঁটের কার্নিশে মৃদু
একটা ভাঁজ পড়ে। এই দৃশ্য রাহাতের চোখে পড়লে রাহাতের
মাথা ঠিক থাকে না। তখন সে মৌমিতার ঠোঁট নিজের মুখে
নিয়ে নেয়। এখনো তাই করল।
হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখে সাত আট জন লোক তাদের দিকে
কেমনভাবে তাকিয়ে আছে। রাহাতের মেজাজ খারাপ হয়ে
গেল। চিৎকার করে বলল, আপনাদের সমস্যা কী? নিজের বউকে
নিয়ে নির্জনে একটু গল্প করছি, আপনারা এভাবে ডিস্টার্ব
করছেন কেন? টাকাপয়সা লাগবে? এই নেন, মানিব্যাগ। নিয়ে
চলে যান।
কেউ মানিব্যাগ নিতে এগোলো না। কিছুক্ষণ পর রাহাত
মানিব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। মৌমিতাও উঠে দাঁড়িয়েছে।
মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়েছে। মৌমিতা আগের মত তাকে
জড়িয়ে ধরে বসে আছে। গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে আর
মৌমিতা আরও শক্ত করে ধরে আছে। সবাই দেখছে, একটা ছেলে
একা একা কথা বলছে। দোকানদার দেখেছিল একটা ছেলেকে।
কেউ মৌমিতাকে দেখেনি। একমাত্র রাহাতই মৌমিতাকে
দেখে। তার অস্তিত্ব টের পায়।
পরিশিষ্টঃ দুইবছর আগে রাহাতের সাথে মৌমিতার প্রেমের
সম্পর্ক ছিল। তাদের বিয়েও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের
তিনদিন আগে একটা দুর্ঘটনায় মৌমিতার মৃত্যু হয়। তারপর থেকে
রাহাতের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সে তার মত করে
মৌমিতাকে নিজের মাঝে উজ্জীবিত করে রেখেছে। সে
মৌমিতাকে দেখতে পায়, তার কথা শুনতে পায়, তার শরীরের
গন্ধ পায় এমনকি তার স্পর্শও পায়।
এটা ভালবাসা নয়, ভালবাসার ঊর্ধ্বে অপার্থিব কোন মায়া।
মোঃ ইউসুফ
Comments
Post a Comment