Skip to main content

লঙ্কা

লঙ্কা

কাকাবাবু বললেন, অসম্ভব! তোমার এ-কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি এ-প্রসঙ্গ আর আমার কাছে বোলো না, অন্য কথা বলো?

অরিজিৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কাকাবাবু, আমার যে আর অন্য কোনও উপায় নেই।
কাকাবাবু ধমকের সুরে বললেন, হ্যাঁ, উপায় আছে। তুমি এক্ষুনি চান করে নাও, তারপর ভাল করে খাওন্দাও, তারপর একটা লম্বা ঘুম দাও! অরিজিৎ আবার বলল, কাকাবাবু, তুমি বুঝতে পারছ না…
কাকাবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার আর বোঝার দরকার নেই।
তারপর তিনি গলা চড়িয়ে ডাকলেন, সন্তু! সন্তু!সন্তু একটু আগেই ব্যাডমিন্টন খেলে ফিরেছে। কাকাবাবুর ঘরে একবার উঁকি মেরে ওপরের ঘরে চলে গেছে। কাকাবাবুর ডাক শুনে নীচে নেমে এল তরতর করে। মা-বাবা বেড়াতে গেছেন। পুরী, বাড়িতে আর বিশেষ লোকজন নেই।

কাকাবাবুর ঘরে একজন ভদ্রলোককে দেখতে পেল সন্তু, মুখটা চেনা-চেনা। খুব সম্ভবত মধ্যপ্রদেশে কোথাও দেখা হয়েছিল। কিন্তু এখন তার মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। মাথার চুল ধুলোবালি-মাখা, তার গায়ের প্যােন্টশার্ট দোমড়ানো-মোচড়ানো, কেমন যেন পাগল-পাগল চেহারা।
কাকাবাবু বললেন, অরিজিৎকে চিনতে পারছিস তো, সন্তু? অরিজিৎ সিকদার। সেই একবার বস্তার জেলার নারানপুরে এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুর মনে পড়ে গেল। ভদ্রলোক একজন বটানিস্ট। সারা ভারতের বিভিন্ন জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরে বিচিত্র সব গাছ খুঁজে বেড়ান। সেবারে তিনি বস্তার জেলার জঙ্গলে বুনো চা-গাছ খুঁজছিলেন। অনেক জঙ্গলেই নাকি একরকম বুনো চা-গাছ আছে, চাষ করতে হয় না। নিজে-নিজেই জন্মায়, আগে কেউ তার সন্ধান রাখত না।

কিন্তু সেবারে তো ভদ্রলোককে খুব শান্ত আর ভদ্র মনে হয়েছিল, হঠাৎ তাঁর এইরকম চেহারা হল কী করে?
কাকাবাবু আবার বললেন, দিল্লিতে আমার সঙ্গে কাজ করত। সত্যেন, এই অরিজিৎ তার ভাইপো। ওকে অনেক ছোট বয়েস থেকে দেখছি, তখন থেকেই ও আমাকে কাকাবাবু বলে ডাকে। অরিজিৎ আজ রাত্তিরে এখানেই থাকবে, বুঝলি। ওর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে বল রঘুকে, আর চান করার জন্য ওকে বাথরুমটা দেখিয়ে দে।অরিজিতের দিকে, তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে আর তো কোনও পোশাক নেই। তুমি আমারই একটা পাজামা, পাঞ্জাবি পরে নাও আজি।
অরিজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে একবার কাকাবাবু আর একবার সন্তুর দিকে তাকাতে লাগল। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। তার এক হাতে একটা ছোট্ট টিনের কৌটো।
কাকাবাবু আলমারি খুলে পাজামা, পাঞ্জাবি বার করলেন, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, অরিজিৎ, তোমার ওই কৌটোটা আমার কাছে রেখে যাও।

অরিজিৎ হঠাৎ জোরে চেঁচিয়ে বলল, না, এটা আমার কাছেই থাকবে!
কাকাবাবু বললেন, তুমি চান করতে যােচ্ছ, ওটা সঙ্গে নিয়ে যাবে নাকি? ওটা আমার কাছেই থাক।
অরিজিৎ কৌটোটা পেছন দিকে লুকিয়ে প্রায় হুঙ্কার দিয়ে বলল, না! এটা আমি কাউকে দিতে পারব না?
তার চোখ দুটো এমন জ্বলছে যে,সেদিকে তাকালে গা ছমছম করে।
কাকাবাবু অবশ্য বিচলিত হলেন না। তিনি অরিজিতের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে চেয়ে রইলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে গভীর আদেশের সুরে বললেন, দাও, দাও। ওটা আমাকে।
কাকাবাবুর ওইরকম গলার আওয়াজ শুনে অনেক বাঘা-বাঘা বদমাশকেও ঘাবড়ে যেতে দেখেছে সন্তু। অরিজিৎ আর কিছু বলতে পারল না। কোটোটা সে তুলে দিল কাকাবাবুর হাতে। তার হাতটা কাঁপছে।
কৌটোটার মধ্যে কী আছে, তা দেখার দারুণ কৌতূহল হল সন্তুর, কিন্তু কাকাবাবু সেটা খুলেও দেখলেন না। রেখে দিলেন জামা-কাপড়ের আলমারিতে। তারপর এমনভাবে পিছন ফিরে একটা বই হাতে তুললেন যাতে তাঁর সঙ্গে আর কোনও কথা বলা না চলে।
সন্তু অরিজিৎকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিল দোতলার বাথরুমটা। একটা নতুন সাবান আর তোয়ালে এনে দিল।তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি দাড়ি কামবেন? কাকাবাবুর কাছ থেকে ব্লেড এনে দেব?
অরিজিৎ রুক্ষভাবে বলল, না, দরকার নেই!
অরিজিৎ স্নান করল প্ৰায় এক ঘন্টা ধরে।

এর মধ্যে সন্তু দু-তিনবার কাকাবাবুর ঘরে উঁকি মেরেছে, যদি কৌটোটা সম্পর্কে কিছু জানা যায়। কাকাবাবু একমনে বই পড়েই চলেছেন। এই সময় তাঁকে বিরক্ত করা সম্ভব নয়।
ঠিক আটটার সময় খাবার দিয়ে দেওয়া হল। কাকাবাবু রাত্তিরে রুটি খান। সন্তু ভাত ভালবাসে। রঘু ভাত আর রুটি দুরকমই বেশি করে বানিয়েছে, তার সঙ্গে ডাল, বেগুনের ভ্যতা আর মুরগির মাংস।
খাবার টেবিলে বসার পর কাকাবাবু অরিজিৎকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি রুটি খাবে, না ভাত?অরিজিৎ বলল, ভাত! না, রুটি। থাক, ভাতাই খাব। কিংবা, রুটি কি বেশি আছে?
কাকাবাবু বললেন, তুমি দুটোই খাও।
কাকাবাবু রুটি খান ঠিক তিনখানা। অরিজিৎ খেল আটখানা রুটি। তারপর সে ভাত নিল। সন্তু যতটা ভাত খায়, অরিজিৎ নিল তার তিন গুণ। রঘু তাকে ভাত দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে, সে না বলছে না।
সে এমনভাবে খাচ্ছে, যেন বহুদিন খেতে পায়নি। কিন্তু কয়েকদিন উপোস করলেও কি মানুষ একসঙ্গে বেশি খেতে পারে? অরিজিতের রোগা-পাতলা চেহারা। এরকম চেহারার কোনও লোককে সন্তু কখনও এতখানি খেতে দ্যাখেনি।
সবটা ভাত শেষ করার পর অরিজিৎ আরও দুটুকরো মাংস আর একটু ঝোল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর রুটি নেই?
আর-একখানা মোটে রুটি বাকি ছিল, রঘু সেটাই দিয়ে দিল।কাকাবাবু এঁটো হাতে চুপ করে বসে অরিজিতের খাওয়া দেখলেন। তারপর বললেন, এইবার গিয়ে একটা ঘুম দাও। মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। দিল্লিতে টেলিফোনে তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাও?
অরিজিৎ দুদিকে শুধু মাথা নাড়ল।
হাত ধোয়ার পর অরিজিৎ কাকাবাবুর ঘরে এসে বলল, এবার আমার কৌটোটা দিন, ওটা আমার ঘরে রাখব।

কাকাবাবু বললেন, ওটা আমার কাছে থাকলে অসুবিধের কী আছে?
অরিজিৎ বলল, আপনি বুঝতে পারছেন না, ওটা কোনওক্রমে নষ্ট হয়ে গেলে মহা ক্ষতি হয়ে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, আমার কাছে থাকলে নষ্ট হবে কেন? আমি গগন বোসের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি, কাল সকাল এগারোটায় জিনিসটা সায়েন্স কলেজে নিয়ে যাব।অরিজিৎ উত্তেজিতভাবে বলল, সায়েন্স কলেজে? ওরা কিছু বুঝবে না। ওটা সুইডেনে পাঠাতে হবে। সেখানে এই ব্যাপার নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, সুইডেনে পাঠাবারই ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু আজ রাত্তিরে আমার কাছে রাখতে তোমার এত আপত্তি কেন?
ওটা আমার জিনিস! আমি ছাড়া কেউ এর সন্ধান জানে না?
ওটা তোমার জিনিস, তা মানছি! কিন্তু আমাকে যদি তোমার এতই অবিশ্বাস, তা হলে ওটা নিয়ে আমার বাড়িতে এসেছি কেন! আর এসেই যখন পড়েছি, তখন তোমাকৈ আমি মোটেই পাগলামির প্রশ্রয় দিতে পারি না।
সন্তু আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, কোটোটার মধ্যে কী আছে?
কাকাবাবু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অরিজিৎকে বললেন, আচ্ছা, একটুখানি বসে যাও। তোমার ঘটনাটা সন্তুকে বলে।
বারবার নিজের মুখে বললে এক সময় নিজেই তুমি বুঝতে পারবে যে, সবটাই বানানো। তোমার কল্পনা। হয়তো এরকম একটা ব্যাপার কখনও স্বপ্নে দেখেছ, তারপর সেটাকেই সত্যি বলে ধরে বসে আছ। এরকম কিন্তু বাস্তবে হতে পারে না।
অরিজিৎ একটা চেয়ারে বসে পড়ে মুখ গোঁজ করে বলল, ও ছোট ছেলে, ও এসবের কী বুঝবে?
কাকাবাবু বললেন, সন্তু তোমার চেয়ে বয়সে অনেকে ছোট হতে পারে, কিন্তু ওর অভিজ্ঞতা কম নয়। তুমি যে-অঞ্চলটার কথা বলছি, সন্তুও সেখানে আমার সঙ্গে গিয়েছিল। সন্তু, সেই যে সেবারে আমরা নেপাল থেকে এভারেস্টের রুট ধরে গিয়েছিলাম, মনে নেই? সেই একটা অতি-মানবের দাঁতের খোঁজে?
সন্তু বলল, সে-ঘটনা কখনও ভোলা যায়? উঃ, কী শীত ছিল, তারপর সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে…
কাকাবাবু বললেন, অতিজিতের ঘটনার ব্যকগ্রাউন্ডটা আমি তোকে বলে দিচ্ছি। অরিজিৎ তো বনে-জঙ্গলে নানারকম, অদ্ভুত-অদ্ভুত গাছপালা খুঁজে বেড়ায়? এবারে সরকার থেকে ওকে পাঠানো হয়েছিল নেপালে। বারো-তেরো হাজার ফিট উঁচুতেও কিছু-কিছু গাছ জন্মায়। সেখানে নাকি কোথাও-কোথাও একরকম স্ট্রবেরি গাছ দেখতে পেয়েছে। কেউ-কেউ। অত ঠাণ্ডায় স্ট্রবেরি গাছ কী করে বেঁচে থাকে সেটাই ওর গবেষণার বিষয়। কী তাই তো?
অরিজিৎ ঘাড় নাড়ল।
কাকাবাবু বললেন, অরিজিৎ যে-জায়গাটা বেছে নিয়েছিল, সেখানে দু-একটা গ্রাম আছে, সেখানে ইয়েতিরা এসে মাঝে-মাঝে উপদ্রব করে বলে গুজব আছে।
সন্তু হাসতে-হাসতে বলল, তুমি একটু আগে যে-আভিযানের কথা বললে, সেবারে আমরা বেশ কয়েকটা ইয়েতি দেখেছিলুম, তাই না?কাকাবাবুও এবার একটু মুচকি হেসে ফেললেন।
অরিজিৎ বলল, তোমরা ইয়েতি দেখেছিলে? সত্যি?
সন্তু বলল, এমন মেক-আপ দিয়েছিল যে, আসল না। নকল, তা বোঝাই যায়নি অনেকক্ষণ।
অরিজিৎ জিজ্ঞেস করল, মেক-আপ দিয়েছিল মানে? সেজেছিল? করা?
কাকাবাবু বললেন, সে অনেক লম্বা গল্প। সেটা পরে শুনে নিও। আসল ব্যাপার হচ্ছে, ইয়েতি বলে খুব সম্ভবত কোনও প্রাণী নেই।
অরিজিৎ জোর দিয়ে বলল, আলবাত আছে!
তুমি বললেই তো হবে না। এ পর্যন্ত কেউ কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি। কত লোকই তো বলেছে যে, ইয়েতি দেখেছে নিজের চোখে, কিন্তু কেউ একটা ছবি তুলতে পেরেছে?
ইয়েতির পায়ের ছাপ অনেকেই দেখেছে। মস্ত বড় পায়ের ছাপের ছবিও তোলা হয়েছে।বরফের ওপর পায়ের ছাপ, সেটা আবার প্রমাণ নাকি? মানুষের পায়ের ছাপও বরফের ওপর কিছুক্ষণ বাদে অন্যরকম হয়ে যায়।

তবু আমি বলছি, ইয়েতি আছে!
না নেই! আমি নেপালে অন্তত তিন-চারজনের মুখে শুনেছি, তারা ইয়েতি দেখেছে। কিন্তু তাদের একটু জেরা করতেই তারা উলটো-পালটা বলতে শুরু করেছে। কেউ বলে গেরিলার মতন দেখতে, কেউ বলে ভালুকের মতন। আবার কেউ বলে, দশ হাত লম্বা মানুষের মতন। তাদের দু-একজনের সঙ্গে ক্যামেরাও ছিল, তবু ছবি তুলতে পারেনি, তার কারণ নাকি ইয়েতিকে একপলক দেখার পরই অদৃশ্য হয়ে গেছে। যত্ত সব গাঁজাখুরি কথা! আসলে বরফের ওপর দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটলে ক্লান্ত হয়ে অনেকে চোখে ভুল দেখে।মরুভূমিতে যেমন মানুষ মরীচিকা দেখে।
কাকাবাবু, আসল ব্যাপারটা কিন্তু আপনিই ঠিক বলেছিলেন।
তার মানে?
ইয়েতিরা অদৃশ্য হয়ে যায়।
অরিজিৎ, এবার ঘুমোতে যাও! আবার কাল সকালে কথা হবে!আমার কথাটা ভাল করে শুনুন, কাকাবাবু! আমিও তো বিজ্ঞান পড়েছি, কোনও প্রমাণ না পেলে একেবারে গাঁজাখুরি কথা আমি মেনে নেব কেন? নেপালের অন্তত দুটো পুরনো পুঁথিতে লেখা আছে, ইয়েতিদের হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাবার ক্ষমতা আছে। আমি নিজেও তার প্রমাণ পেয়েছি। এইজন্যই ইয়েতির ছবি তোলা যায় না। মানুষের চোখের সামনে পড়ে গেলেই ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়। পুঁথিতে যা কিছু লেখা থাকে, তাই-ই সত্যি নয়।  বললাম যে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। এমনকী আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, অরিজিৎ বলতে চায়, হিমালয়ের কোনও একটা জায়গায় নাকি এক রকমের ফল পাওয়া যায়, যা খেলে অদৃশ্য হওয়া যায়। ইয়েতিরা নাকি সেই ফল খায়।আমাদের অরিজিৎ সেই ফলের সন্ধান পেয়েছে। এমনকী নিজে সেই ফল খেয়েই দেখেছে!
অরিজিৎ ব্যাকুলভাবে বলল, আপনি এখনও আমার কথা বিশ্বাস করছেন না??
কাকাবাবু বললেন, এসব রূপকথার মতো গল্প, শুনতেই ভাল। কিন্তু বিশ্বাস করার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। শোনো, জল জিনিসটা গরম হলে বাষ্প হয়, তারপর সেই বাষ্প উড়ে যায়। এমনকী অনেক ধাতুকেও প্রচণ্ড উত্তাপে গলিয়ে বাষ্প করা যায়, আবার ঠাণ্ডা হলে সেই ধাতু বা জল ফিরে আসে। কিন্তু কোনও জীবন্ত প্ৰাণীকে বেশি গরমে রাখলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, সেই ছাইটাকে ঠাণ্ডা করলে কিন্তু সেই প্ৰাণীটাকে ফেরত পাওয়া যাবে না। কোনও জীবন্ত প্ৰাণী, এমনকী একটা পিঁপড়েকেও অদৃশ্য করে আর ফিরিয়ে আনা অসম্ভব!সন্তু আমতা-আমতা করে বলল, কিন্তু কাকাবাবু, বৈজ্ঞানিকরা টাইম-মেশিনে কি মানুষকে অদৃশ্য করতে পারবে না? স্টার-ওয়ার্স ফিলমে যে দেখি, একটা যন্ত্রের মধ্যে দাঁড়ালে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার অন্য জায়গায় ফিরে আসছে?
কাকাবাবু বললেন, ওসবও এ-যুগের রূপকথা। আগেকার গল্পে যেমন রাজপুত্ৰ পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে আকাশে উড়ে যেত, এখনকার গল্পেও তেমনি নায়করা স্পেস-শিপে চেপে অন্য গ্রহে যায়, এমনকী এই গ্যালাক্সি পেরিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করে আসে। এসব রূপকথা-ছাড়া কিছুই না।
অরিজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যদি আপনার চোখের সামনে করে দেখাতে পারি? আমাকে কোটোটা একবার দিন।
কাকাবাবু আর কিছু বলার আগেই সে ছুটে গিয়ে জামাকাপড়ের আলমারিটা খুলে কৌটোটা বার করে এনে বলল, আমি নিজে দুবার এক্সপেরিমেন্ট করেছি। দুবারই সাকসেসফুল।
কৌটোটা খুলে সে সন্তুকে দেখাল।
ভেতরের জিনিসটা দেখে সন্তু খানিকটা নিরাশ হয়ে গেল। এটা তো একটা লঙ্কা। বেশ বড়সড় টাবাটোবা গোলগাল লাল লঙ্কা!
অরিজিৎ যেন তার মনের কথাটাই বুঝতে পেরে বলল, এটা লঙ্কা বলে মনে হচ্ছে তো? কিন্তু এটা এক ধরনের স্ট্রবেরি। এটা ঝাল নয়। মোটেই, বরং টক-মিষ্টি। কাকাবাবু শুনলে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু তোমাকে বলছি। সন্তু, একেবারে সত্যি কথা বলছি! পাহাড়ে স্ট্রবেরি খুঁজতে-খুঁজতে, ঝোপঝাড়ে যেখানে যে ফল দেখতাম, অমনি আমি তা খেয়ে স্বাদ নিতাম।কোনও বিষাক্ত ফল খেয়ে ফেলারও কুঁকি ছিল অবশ্য। একদিন আমি এই ফল একটা খেয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলুম!
কাকাবাবু বললেন। হুঁ!
সন্তু বলল, সত্যি বলছেন?
অরিজিৎ বলল, দেড়দিন সেই অবস্থায় ছিলুম। সিংবোচি গ্রামে এসে ঘুরেছি, লোকজনের মধ্যে, কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পায়নি। আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম খুব। পরে ওইরকম আর একটা ফল খেয়ে নেবার পর আবার সব ঠিক হয়ে গেল।

সন্তু একবার কাকাবাবু আর একবার অরিজিতের দিকে তাকাল। তারপর কৌটোটা হাতে তুলে নিল।
অরিজিৎ বলল, দারুণ ভাল লাগে সেই সময়টা। কোনও খিদেতেষ্টা থাকে না। দারুণ হালকা লাগে শরীরটা, মানে, শরীরটা অন্য কেউ দেখতে না পেলেও সেটা তো থাকেই। মনটা খুব ফুরফুর করে। যেখানে ইচ্ছে চলে যাওয়া যায়। কতরকম মজা হয়।কাকাবাবু বিদ্যুপের সুরে বললেন, ইয়েতির গায়ে তো পােশাক থাকে না। মানুষের গায়ে যে প্যান্ট-জামা-জুতো থাকে, সেগুলোও অদৃশ্য হয়ে যায়?

অরিজিৎ বলল, দেখবেন? দেখবেন? এক্ষুনি দেখাব? আমি টপ করে ফলটা খেয়ে নেব, তারপর এক মিনিটের মধ্যেই আপনাদের চোখের সামনেই মিলিয়ে যাব! ওটা দাও তো, সন্তু!

অরিজিৎ হাত বাড়াতেই কাকাবাবু প্ৰায় গর্জন করে উঠে বললেন, না! কোনও দরকার নেই!
অরিজিৎ এবার হেসে বলল, কাকাবাবু, আপনি ভয় পাচ্ছেন? আপনি অবিশ্বাস করবেন, আবার ভয়ও পাবেন?
কাকাবাবু বললেন, ওরকম অচেনা ফল খাবার দরকার নেই!
অরিজিৎ বলল, দারুণ ভাল লাগে। দেখলেই খেতে ইচ্ছে হয়। আমি মাত্র তিনটে পেয়েছিলুম, যদি আরও খুঁজে বার করা যায়, তা হলে একটা বিরাট আবিষ্কার হবে?কাকাবাবু বললেন, সন্তু, কৌটোটা আলমারিতে রেখে দে! এবার তোমরা শুতে যাও। আর কোনও কথা নয়! যাও! আমার ঘুম পেয়েছে।
সন্তু অনিচ্ছার সঙ্গেও কৌটোটা রেখে দিল যথাস্থানে। কাকাবাবু এমনভাবে চেয়ে আছেন যে, বেরিয়ে যেতেই হল দুজনকে।

অরিজিৎ সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, সন্তু, আমি কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাইনি। সত্যি ওই ফলটার অদ্ভুত গুণ আছে। ওটা খেলে মানুষ অদৃশ্য হতে পারে। কাকাবাবু বিশ্বাস করলেন না।
অরিজিৎকে তার ঘর দেখিয়ে দেবার পর সে শুয়ে পড়ল। সে সত্যিই খুব ক্লান্ত, একটু বাদেই তার নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল।
সন্তু উঠে গেল তিনতলায়। বড় হবার পর সে এই ছাদের ঘরটা নিজের জন্য পেয়েছে।এখানে সে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করতে পারে। মাঝে-মাঝে ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দ্যাখে।
একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেও তার মন বসল না পড়ায়। অরিজিতের কথাগুলোই মনে পড়ছে বারবার।
ছেলেবেলা থেকেই সন্তু অদৃশ্য হবার স্বপ্ন দেখেছে। অদৃশ্য হতে পারলে সত্যি একটা মজার ব্যাপার হয়। তাকে কেউ দেখতে পাবে না, অথচ সে সবাইকে দেখতে পাবে!
হেমেন্দ্ৰকুমার রায়ের লেখা অদৃশ্য মানুষ নামে একটা বই পড়ে সন্তুর এক সময় মনে হয়েছিল, সত্যিই ওইরকম একজন অদৃশ্য মানুষ আছে। কিন্তু কাকাবাবু বললেন, বিজ্ঞানের দিক থেকেও নাকি অদৃশ্য হওয়া অসম্ভব। অথচ অরিজিতের কথা শুনে মনে হয় না যে, সে আগাগোড়াই মিথ্যে কথা বলছে।খাওয়ার সময় অরিজিৎ অতগুলো খাবার খেল। সে বলল, অদৃশ্য হলে নাকি খিদে-তেষ্টাও পায় না। অদৃশ্য অবস্থা থেকে আবার সাধারণ অবস্থায় ফিরে এলে তখন একসঙ্গে দু-তিন দিনের খিদে পায়?
বই পড়াতেও মন নেই, ঘুমাও আসছে না। বিছনায় শুয়ে ছটফট করছে। সন্তু। ঘড়িতে দেখল রাত দেড়টা বাজে!
বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল সন্তু। মনে হয়। সারা কলকাতাই এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও কোনও শব্দ নেই।
পা টিপো-টিপে দোতলায় নেমে এল সে। অরিজিতের প্রচণ্ড জোরে নাক ডাকছে। কাকাবাবুরও নাক ডাকার বেশ শব্দ হয়। সারা বাড়িতে এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।কাকাবাবুর ঘরে আলো জ্বলছে। কাকাবাবুর এই এক স্বভাব, প্রায়ই আলো জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়েন। মা, বাবা কিংবা সন্তু কেউ একজন পরে এসে আলো নিভিয়ে দিয়ে যায়। আজ বাড়িতে মা-বাবাও নেই।
সন্তু কাকাবাবুর ঘরের দরজাটা ঠেলে খুলল। কাকাবাবু টের পেলেন না। ঘরের মধ্যে কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে রইল সন্তু, তার খুব লোভ হচ্ছে। ফলটা খেয়ে দেখলে কী হয়? কাকাবাবু রাগ করবেন? অরিজিৎ বলেছিল, অদৃশ্য হলেও সেই অবস্থায় দেড় দিনের বেশি থাকা যায় না। দেড় দিন পরেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে! কাকাবাবু অরিজিতের কথায় বিশ্বাস করেননি, সন্তুর কথা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন।আলমারি খুলে সন্তু কৌটোটা বার করল। কাঠের আলমারির পাল্লায় ক্যাঁচ করে সামান্য শব্দ হলেও কাকাবাবু জাগলেন না। সন্তু টপ করে আলো নিভিয়ে, দরজা ভেজিয়ে দৌড়ে উঠে এল ছাদে।
যা থাকে কপালে, খেয়েই দেখা যাক!
সন্তু কাল খেতে পারে না বেশি! ফলটাকে লঙ্কার মতন দেখতে একেবারে টকটকে লাল। যদি এটা লঙ্কা হয়, তা হলে দারুণ ঝাল হবে। সন্তু প্ৰথমে একটা ছোট্ট কামড় দিল। না, ঝাল নয়, একটু মিষ্টি মিষ্টিই। খানিকটা পিপারমেন্টের মতন। খেতে ভাল লাগছে।
পুরো ফলটাই খেয়ে ফেলল সন্তু, কিন্তু কিছুই তো হল না। তা হলে কি অরিজিৎ একদম বাজে কথা বলেছে? ওঃহো, আজ তো ১লা এপ্ৰিল!অরিজিৎ কাকাবাবু আর সন্তুকে এপ্ৰিল ফুল করেছে নির্ঘাত!
একটা কিসের শব্দ হতেই সন্তু ঘুরে তাকাল।
ছাদের পাঁচিলে কারা যেন একটা কালো রঙের মাথা। ওটা কি কোনও মানুষ, না জন্তু?
সন্তু দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়বার চেষ্টা করেও পারল না। তার আগেই মাথাটা যেন বোঁবোঁ করে ঘুরতে লাগল, কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ হল, সে ঝুপ করে পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে।

Comments

Popular posts from this blog

ভালবাসার সঙ্গা:-

ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছেন বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন ভাবে । ব্যক্তি ভেদে এই সংজ্ঞা বদলে যায় , যেমন বিখ্যাত গণিতবিদ পীথাগোরাস কে আমরা সবাই কম-বেশি চিনি। একবার কোন এক “ ভালোবাসা দিবস” এ এক লোক পীথাগোরাস কে জিজ্ঞেশ করেছিল, আপনার কাছে ভালবাসা’র সংজ্ঞা কী হতে পারে? পীথাগোরাস কোনো কথা না বলে খাতা-কলম নিয়ে বসে পরলো। তারপর কিছুক্ষন পর বলল, আমার কাছে ভালবাসা হচ্ছে ২২০ এবং ২৮৪ এর উৎপাদক ।তখন লোকটি বলল , কীভাবে? পীথাগোরাস বলল , ২২০ এর উৎপাদক হলো ১,২,৪,৫,১০,১১,২০,২২,৪৪,৫৫,১১০ এবং ২৮৪ এর উৎপাদক হলো ১,২,৪,৭১,১৪২ এখন আপনি যদি ২২০ এর উৎপাদক গুলোকে যোগ করেন তাহলে যোগফল হবে ২৮৪ (১+২+৪+৫+১০+১১+২০+২২+৪৪+৫৫+১১০=২৮৪) এবং ২৮৪ এর উৎপাদক গুলোকে যোগ করেন তাহলে যোগফল হবে ২২০ (১+২+৪+৭১+১৪২=২২০) কী! মজার না? আবার দেখুন আমাদের দেশের কবি রফিক আজাদের একটা কবিতা আছে, "ভালোবাসার সংজ্ঞা" ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি, পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা; ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া, বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি; ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি খুব করে ঝুঁকে থাকা; ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্

আমি নিজের চোখকে বিস্বাস করাতে পারছিলামনা।

আমি নিজের চোখকে বিস্বাস করাতে পারছিলামনা। - রাইসাঃ কি তুমার বিস্বাস হচ্ছেনা,আমি তুমার সামনে?? - আমিঃ তুমাকে কি আমি স্পর্শ করে দেখতে পারি? - রাইসাঃ আমি কি তুমাকে নিষেদ করেছি! - আমি আমার হাতটা রাইসার হাতের উপরে রাখলাম,আমার ভিতরে অজানা একটা ভাল লাগা কাজ করলো,বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠলো! - এরি নাম হয়তো ভালবাসা! - আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে রাইসাকে দেখছি।। - কখন যে সময় পেরিয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না।।।হঠাৎ রাইসার ডাকে আমার হুশ্ ফিরলো! - রাইসাঃএখন আমাকে যেতে হবে শাকিল। - আমিঃ কেন?আরেকটু থাকোনা! - রাইসাঃ না একটু পরে আযান হবে,আমি আর থাকতে পারবনা, দিনের আলো আমি একদম সহ্য করতে পারিনা।আমি যাচ্ছি ভাল থেকো। রাইসা চলে গেলো। - ঘরটা আগের মতো আবার অন্ধকার হয়ে গেলো।শুধু একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি! - - তার পর বেশ কিছুদিন কেঁটে গেলো,রাইসা আমাকে কল করছে না,দেখা করতেও আসছেনা।। - ভাবলাম ও হয়তো আমাকে ভুলে গেছে! মনের অজান্তেই কখন রাইসাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি,জানিনা। - খুব কষ্ট হচ্ছিলো! রাইসাকে ছাড়া আর কোন কিছু ভাবতে পারছিনা আমি। হোক না সে অন্য কোন জাতি!আমি তু তাকে ভালবাসি আর ভালবাসা

ভারতে কলেজ ছাত্রীর সাথে অস্লিল কর্মের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারকরল বন্ধু।

ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে এক তরুণীকে হেনস্তা করে ভিডিও ছেড়ে দিয়েছে এক যুবক। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ছবি : এনডিটিভি ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে ১৯ বছর বয়সী এক কলেজছাত্রীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পর ভিডিও ধারণ করে তা বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে এক যুবক। এ ঘটনায় ছাত্রীর ছেলেবন্ধু ওই যুবকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চলতি বছরের আগস্টে এ ঘটনা ঘটে। গত মঙ্গলবার ছাত্রীর বাবার করা অভিযোগের ভিত্তিতে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রকাসম জেলা থেকে  তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। Advertisement ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণী হামলাকারীদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে কাকুতি-মিনতি ও আর্তনাদ করছেন। কিন্তু হামলাকারীরা তাঁর পোশাক অনাবৃত করে ধর্ষণের চেষ্টা করছে। ওই সময় হামলার শিকার তরুণীর পাশে থাকা আরেক মেয়েকে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। ওই মেয়েটি তরুণীকে বাঁচাতে সামান্য চেষ্টা করেছেন। অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশের ভাষ্য, ওই কলেজছাত্রী ও তাঁর এক বন্ধু বি সাইয়ের (ছেলেবন্ধু) সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বি সাইয়ের সঙ্গে এক বছর আগে থেকে তরুণীর পরিচয় ছিল। মন্দিরে যাওয়ার পর বি সাইয়ের বন্ধু কার্তিক (যে তরুণীর স